বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা :
টানটান উত্তেজনার মধ্য দিয়ে শনিবার চতুর্থ দফার ভোট গ্রহণ হতে চলেছে পশ্চিমবাংলার বিধানসভা নির্বাচনে। এদিন ৪৪টি আসনে ভোট গ্রহণ হবে। এরই মধ্যে তৃণমূল নেত্রী–সহ অন্য নেতাদের প্রকাশ্য সভায় উসকানি এবং হুমকি দেওয়ার অভিযোগ ওঠায় এই দফার ভোট নিয়ে রীতিমতো সিঁদুরে মেঘ দেখছেন রাজ্যের রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা। এখন দেখার নির্বাচন কমিশন কতখানি সতর্কতার সঙ্গে এই দফার ভোট গ্রহণ নির্বিঘ্নে করাতে পারে!
এই দফায় এক ঝাঁক হেভিওয়েট প্রার্থীর ভাগ্য পরীক্ষা হবে। সেই তালিকায় রয়েছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় থেকে সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায়, রাজ্যের মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, সুজন চক্রবর্তী, রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, মহম্মদ সেলিম, আবদুল মান্নান, বৈশালী ডালমিয়া প্রমুখ। চলচ্চিত্র জগতেরও এক ঝাঁক তারকা প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন এই দফায়। সেই তালিকায় রয়েছেন অভিনেত্রী অঞ্জন বসু, পায়েল সরকার, শ্রাবন্তী চট্টোপাধ্যায়, লাভলি মৈত্র, অভিনেতা যশ দাশগুপ্ত, কাঞ্চন মল্লিক, ফুটবল ও ক্রিকেট জগতের বর্তমান ও প্রাক্তন খেলোয়াড় বিদেশ বসু এবং মনোজ তিওয়ারি। এই দফার ভোট গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, যে সব আসনে ভোট গ্রহণ হবে, সেগুলির অধিকাংশ জায়গায় বিজেপি এবং তৃণমূল সমান শক্তিশালী। ফলে লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি। এর আগে যে ৯১টি আসনে ভোট হয়েছে, সেগুলির মধ্যে প্রথম দুই দফায় তৃণমূল আগে শক্তিশালী হলেও শুভেন্দু অধিকারী তথা অধিকারী পরিবারের সৌজন্যে বিজেপি অনেকটাই চাপে ফেলে দিয়েছে তৃণমূলকে। আর তৃতীয় দফায় ভোট হয়েছে এক কথা তৃণমূলের গড়ে। ফলে চতুর্থ দফার ভোট নিয়ে যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে রাজনৈতিক মহলে।
চতুর্থ দফায় মোট ৪৪টি আসনে ভোট হবে। নির্বাচন হবে মোট পাঁচ জেলায়। এই দফার ভোট শান্তিপূর্ণ এবং নির্বিঘ্নে করানোই চ্যালেঞ্জ নির্বাচন কমিশনের। সেই কারণে মোতায়েন থাকবে ৮৯৯ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী। যদিও কয়েকদিন ধরে যে ভাবে স্বয়ং তৃণমূল দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ঘেরাও করে রাখার জন্য মহিলাদের উসকানি দিয়েছেন, যে কারণে কমিশন তাঁকে নোটিশ পাঠিয়েছে এবং পাল্টা কমিশনকে আক্রমণ করেছেন মমতা, তাতে এই দফার নির্বাচন আদৌ শান্তিপূর্ণ হবে কিনা, তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছে ওয়াকিবহাল মহল। তা ছাড়া যথেষ্ট সংখ্যক কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন থাকলেও আগের তিন দফায় বিক্ষিপ্ত ভাবে হিংসার ঘটনা ঘটেছে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য তথ্যাভিজ্ঞ মহলের বক্তব্য, কেন্দ্রীয় বাহিনীকে নির্বাচন কমিশন নিয়োগ করলেও তাদের নিয়ন্ত্রণ করে রাজ্য প্রশাসন। অনেক ক্ষেত্রেই রাজ্য প্রশাসন নিষ্ক্রিয় করে রাখে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে। ফলে হিংসাত্মক ঘটনার সময় কেন্দ্রীয় বাহিনীকে সে ভাবে সক্রিয় হতে দেখা যায় না। ফলে হিংসাও সে–ভাবে ঠেকানো যায় না।
এদিকে, এই দফার ভোট নিয়ে তৃণমূল গন্ডগোল পাকাবে বলে অভিযোগ করেছে বিজেপি–সহ বিরোধী দলগুলি। তাদের বক্তব্য, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে ভাবে কেন্দ্রীয় বাহিনী এবং নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক ভাবে তোপ দেগে যাচ্ছেন, তাতে তৃণমূল কর্মীরা প্ররোচিত হবেন হিংসার ঘটনা ঘটাতে। ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে হুমকি দিয়ে বিতর্কে জড়িয়েছেন নাটাবাড়ি কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী তথা মন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ঘোষও। বিজেপির অভিযোগ, কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে যে ভাবে শুক্রবার উসকানি দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঘোষ, তাতে আইন শৃঙ্খলার অবনতি হতে পারে। সেই কারণে কোচবিহারের কোতোয়ালি থানায় পুলিশের কাছে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে এফআইআরও করেছেন বিজেপি নেতারা। নাটাবাড়ির বিজেপি প্রার্থী মিহির গোস্বামী অভিযোগ করেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঘোষ ভোটের দিন নাটাবাড়ি কেন্দ্রে অশান্তি পাকানোর ষড়যন্ত্র করেছেন। তাই আমরা নির্বাচন কমিশনের কাছে অনুরোধ করছি, সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার স্বার্থে অবিলম্বে রবীন্দ্রনাথ ঘোষকে ক্লোজ করা হোক।’’
এর মধ্যে সেই বিতর্ক আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন তৃণমূল নেতা তথা রাজ্যের মন্ত্রী গৌতম দেব। প্রচারে বেরিয়ে ডাবগ্রাম–ফুলবাড়ি কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী গৌতম দেব ঠাকুরনগরের একটি আশ্রমের সন্ন্যাসীকে হুমকি দিয়ে বলেছেন, ‘আমাদের বিরোধিতা করলে এখান থেকে উচ্ছেদ করে দেব। আমি গৌতম দেব, যা বলি তাই করি। এখানে বিজেপি করবেন না। ও–সব মোদির রাজ্যে হয়। এখানে চলবে না।’ এই ঘটনা উপস্থিত ব্যক্তিদের একজন ভিডিও করে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে দেন। আর তা প্রকাশ্যে আসতেই তুমুল বিতর্ক তৈরি হয়। এর পরই ওই সন্ন্যাসীর সঙ্গে দেখা করেন বিজেপি প্রার্থী শিখা চট্টোপাধ্যায়। তিনি তাঁকে আশ্বস্ত করে বলেন, ‘‘চরম হতাশা থেকেই গৌতম দেব এ–সব বলছেন।’ তিনি নির্বাচন কমিশনকে এই ঘটনার কথা জানিয়ে অভিযোগ করেছেন। কমিশন ঘটনা খতিয়ে দেখছে বলে জানা গিয়েছে। এ ছাড়া তৃণমূল নেতা শেখ মইনুদ্দিনের বিরুদ্ধেও সাধারণ মানুষকে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। একটি সভায় তিনি প্রকাশ্যেই হুমকি দিয়ে বলেছেন, ‘তৃণমূলকে ভোট না দিলে মিলবে না সরকারি সুবিধা। আইএসএফ–কে ভোট দিলে ফল ভালো হবে না।’ তৃণমূল নেতার এমন হুমকির তীব্র সমালোচনা করেছেন আইএসএফ প্রধান আব্বাস সিদ্দিকি।
এদিন যে কেন্দ্রগুলিতে ভোট গ্রহণ হবে, সেগুলি হল হুগলির উত্তরপাড়া, শ্রীরামপুর, চাঁপদানি, চণ্ডীতলা, সিঙ্গুর, চন্দননগর, চুঁচুড়া, বলাগড়, পাণ্ডুয়া, সপ্তগ্রাম, হাওড়ার বালি, শিবপুর, হাওড়া উত্তর, হাওড়া মধ্য, হাওড়া দক্ষিণ, ডোমজুড়, উলুবেড়িয়া পূর্ব, পাঁচলা, সাঁকরাইল, উত্তরবঙ্গের মাথাভাঙা, মেখলিগঞ্জ, মাথাভাঙা, কোচবিহার উত্তর, কোচবিহার দক্ষিণ, শীতলকুচি, সিতাই, দিনহাটা, নাটাবাড়ি, তুফানগঞ্জ, কুমারগ্রাম, কালচিনি, আলিপুরদুয়ার, ফালাকাটা, মাদারিহাট, দক্ষিণ ২৪ পরগনার সোনারপুর দক্ষিণ, সোনারপুর উত্তর, মহেশতলা, বজবজ, ভাঙর, বৃহত্তর কলকাতার মেটিয়াবুরুজ, যাদবপুর, টালিগঞ্জ, বেহালা পূর্ব, বেহালা পশ্চিম, কসবা।
আরও পড়ুন : আচরণবিধি লঙ্ঘনে আবারও নোটিশ পেলেন মমতা